জেমস আব্দুর রহিম রানা: যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই বছর আগে হত্যা মামলার দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার মনোয়ার মেম্বার হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁসি হয়। যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে তারা হলেন ইস্ট বেঙ্গল কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা মোকিম ও ঝারু। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করেছে, সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ করেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
আজ (৪ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চে মামলাটি শুনানির জন্য মামলার তালিকায় ছিল। কিন্তু শুনানির আগেই জানা যায়, আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।
আপিলকারীর আইনজীবী আসিফ হাসান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আসামির আইনজীবী হিসেবে তিনি আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হুমায়ুন কবির তাকে মামলার শুনানি করতে বলেন। তার পরামর্শে আসিফ হাসান মামলার শুনানির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নেন। এরপর তিনি তাকে ফোন করে জানান, মামলার দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এর আগে তিনি জানতেন না যে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।
আইনজীবীরা বলছেন, বিধি অনুযায়ী আদালতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমতি প্রয়োজন। মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্ট কর্তৃক অনুমোদিত হলে তা কার্যকর করতে আরও কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তবে মামলার কোনো পক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে তা নিষ্পত্তির জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে অপেক্ষা করতে হয়।
তবে আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ চুয়াডাঙ্গার মকিম ও ঝারু নামে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করে। আইনজীবীরা জানান, মামলার জবানবন্দিতে মকিম ও ঝাড়ুর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২ তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড, দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্য আসামিদের খালাস দেন। আসামিরা হলেন একই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মকিম ও ঝাড়ু। বিচারিক আদালতের রায়ের পর মামলাটি বিধি মোতাবেক আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে আসে। মামলার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ছিল ৩৯/২০০৮। শুনানি শেষে হাইকোর্ট মকিম ও ঝাড়োর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং ২০১৩ সালের ৭ ও ৮ জুলাই মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাকি আসামিদের খালাস দেওয়া হয়।
পরে মকিম (আপীল নং 111/2013) এবং ঝারু (আপীল নং 107/2013) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন। এরপর মকিমের পক্ষে আপিল মামলার দায়িত্ব নেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হুমায়ুন কবির। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ আট বছর। সম্প্রতি আপিল বিভাগে আপিল শুনানির জন্য আসে।
মামলাটি শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত হওয়ার পর, আইনজীবীরা দরিদ্র মকিমের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে এবং জানতে পারেন যে জেল কর্তৃপক্ষ আপিল নিষ্পত্তির আগেই 2017 সালে মকিমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। এমনকী অপর আসামি ঝাড়োর মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়েছে বলে জানা গেছে।
নিয়মানুযায়ী কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্টে অনুমোদনের পর আপিল করা হলে আপিল বিভাগ এ বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে কারা কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট ডিসির কাছে যায়। ফলে ওই সময়ের জন্য সাজা স্থগিত করা হয়।
তদারকি করতে গিয়ে আইনজীবী হুমায়ুন কবির নিজেই ঘটনার সত্যতা জানতে পারেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মকিম একজন কনডম বন্দী। আবেদনকারীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, কনডম বন্দী মকিম ও ঝাড়োর মৃত্যুদণ্ড ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। মূলত মকিম ও ঝাড়ু পরিবার খুবই দরিদ্র। তাই পরিবারের সদস্যরা তাদের পক্ষে মামলার বিস্তারিত জানতে পারেননি। আইনজীবী বলেন, তাদের সেই যোগ্যতা নেই।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের মৃত রবকুল মন্ডলের ছেলে মনোয়ার হোসেনকে ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন গ্রামের বাদল সরদারের বাড়িতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা কুপিয়ে হত্যা করে। ওই দিনই নিহতের ভাই আহিম উদ্দিন আলমডাঙ্গা থানায় ২৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে দুর্লভপুরের মৃত মুরাদ আলীর ছেলে আব্দুল মকিম ও একই গ্রামের মৃত আকছেদ আলীর ছেলে ঝারুসহ তিনজনকে কারাদণ্ড দেন আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দুর্লভপুরের মৃত কুদরত আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম ও একই গ্রামের আবু বক্করের ছেলে হিয়াসহ আরও দুজনকে। বাকি আসামিদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত।রায় ঘোষণার পর আসামিদের স্বজনরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিল বিভাগ আপিলের শুনানি শেষে একজন আসামি আমিরুল ইসলাম এবং মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ক্ষমা করে দেন। মকিম ও ঝাড়ুর ফাঁসির আদেশ বহাল রয়েছে। ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে মকিম ও ঝাড়ুর ফাঁসি হয়।
এদিকে, বুধবার আপিল নিষ্পত্তির আগে ২০১৭ সালে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হওয়ার খবরে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তবে কারাগারের একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, মকিম ও ঝাড়োর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সে সময় সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর। সূত্রের দাবি, আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার পর দুই আসামি মৃত্যুদণ্ড কমানোর জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এই অনুরোধ অস্বীকার করেছেন।
22 অক্টোবর 2017 তারিখে, মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশে সহকারী সচিব মোহাম্মদ আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে কারা কর্তৃপক্ষকে আবেদন প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে অবহিত করা হয়। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ১৮ নভেম্বর দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে তাদের দুজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ওই রাতেই নিহত দুইজনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে কারা কর্তৃপক্ষ। আবু তালেব তখন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর।
বর্তমান কারারক্ষী তুহিন কান্তি খান বলেন, “এমন খবর শোনার পর আমি নিজেই ফাইলগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি। কোথাও কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়নি। রাষ্ট্রের সব আইনি বিধান মেনেই দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
খুলনা বিভাগীয় কারা অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক ছগির মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, আপিল নিষ্পত্তির আগেই ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর কারাগারে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয় বলে আমরা জানতে পেরেছি। কারা কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র পরীক্ষা করছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিষয়টি স্পষ্ট করা হবে। ‘
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।